প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পরবর্তী বৈঠকে বিএনপি আবারও তার দলীয় অবস্থান স্পষ্ট করে দেবে। এই বৈঠকে জামায়াতে ইসলামী বাদে অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে বিএনপি জোট করতে পারে, যদি নির্বাচনে জয়ী হয় তারা, তাহলে একসঙ্গে সরকার গঠন করারও পরিকল্পনা রয়েছে। বিএনপির দলীয় সূত্র জানিয়েছে, গত সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই বিষয়গুলি আলোচনা হয়েছে। এই বৈঠকে সংস্কার বিষয়ে কোনও ছাড়ের সম্ভাবনা দেখা যায়নি। বৈঠকে ভার্চুয়ালি অংশ নেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, যারা নেতৃত্বে ছিলেন।ে দলটির মতে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট বা গণপরিষদের দাবি অপ্রচলিত এবং অযৌক্তিক। তারা সংবিধানের ওপরে এই সনদকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টিও গ্রহণযোগ্য নয়। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে কার্যকরি সংস্কার করতে হলে তা পরবর্তী সংসদে হবে। বাকি সংস্কারগুলো যদি সরকার চায়, তাহলে তা আইনগত প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের আগে কার্যকর করতে পারে। বৈঠক সূত্র জানায়, জামায়াতে ইসলামি, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপির দলগুলো যদি সংস্কারের জন্য বৈঠক দেয় তবে বিএনপি তা গুরুত্ব দেবে না। গত ১৬ আগস্ট জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এই সব দলের কাছে জুলাই সনদের খসড়া পাঠিয়েছে। এর মধ্যে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে মতামত নেওয়া হয়। এরমধ্যে আট দফার অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, এই সনদকে সংবিধানের উপরে প্রাধান্য দেওয়া হবে, আদালতের প্রশ্নমুক্ত রাখা হবে এবং নির্বাচনের আগে এই সংস্কারগুলো কার্যকর করা হবে। বিএনপি গত ২০ আগস্ট ৩৫ পৃষ্ঠার মতামত পাঠায়, যেখানে তারা স্পষ্ট করে দেয় যে সংবিধানই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনি_REFERER_এ, সুতরাং এই সনদকে সংবিধানের ওপরে রাখার কোনও প্রশ্নই আসে না। দলটি বলছে, ৮৪টির মধ্যে ৭৩টিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য রয়েছে, তবে ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন, দুর্নীতির দমন কমিশন এবং সাংবিধানিক কমিটি গঠনের মতো বিষয়গুলোতে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। এইসব বিষয়গুলোয় রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রয়েছে, সাংবিধানিক সংস্কার না হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চান তারা। জামায়াত চাইছে গণভোট বা রাষ্ট্রপতির ঘোষণা, এনসিপি চায় গণপরিষদ গঠন করে সংস্কার চালানো। এই পরিস্থিতিতে ইউনিয়নীয় বৈঠক শেষে চলতি রোববার আইন উপদেষ্টা, অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে কমিশন। এই আলোচনা আলোচনা হয়েছে, যেন জুলাই সনদটি আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে কার্যকরী হয়। এর মধ্যে গণভোট ও সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব কি না এ বিষয়েও আলোচনা হয়। এরপর বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংস্কারে গণভোট বা গণপরিষদের কোনো যৌক্তিকতা নেই কারণ এই সনদে ৮৪টি সিদ্ধান্ত রয়েছে, তাই একাবার গণভোট করা সম্ভব নয়। দলটি মনে করে, সংবিধানই সর্বোচ্চ আইন, সেই জন্য এই সনদ সংবিধানের উপরে থাকতে পারে না। তিনি আরো বলেন, বিএনপি মনে করে, এই সনদে স্বাক্ষর করা দলগুলোর অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া যথেষ্ট, এবং যদি কেউ অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তবে জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাদের জবাব দেবে। বৈঠক সূত্র জানায়, বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকার ছাড়া নির্বাচন করতে চায় না। তারা চায়, চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হোক, এবং পরবর্তীতে নির্বাচনোত্তর অন্তর্বর্তী সরকারই সকল সংস্কার কার্যকর করবে। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কিছু বিষয় অযৌক্তিক মনে করছে বিএনপি। দলটি আর কোনও অঙ্গীকারে বিশ্বাস করে না। তারা চাইছে, আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো একটি সমঝোতায় পৌঁছে। যারা ‘ছাড়’ দিয়েছে বিএনপি প্রথমে, সেগুলোর মধ্যে এক ধরনের অঙ্গীকার ছিল, যেমন একজন ব্যক্তি দুটিবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, এই বিষয় প্রত্যাখ্যান করেন দলটি। পরে তারা সাংবিধানিক কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টিও মেনে নেয়। হাইকোর্টের বিভাগীয় শহরে নেওয়ার প্রস্তাব তারা প্রথমে রাজি ছিল না; পরে আলোচনার মাধ্যমে এতে সম্মতি দেয়। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে নিযুক্তি করার বিষয়ে আপোস করা হয়েছে। নারীদের জন্য অন্তত ৫ শতাংশ মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়েও দলটি কিছুটা শিথিলতা দেখিয়েছে। নির্বাচনে বিরোধিতায় বিএনপি কোনো বিচলিত নয়। তারা মনে করে, ভোটের অনুপাত বা গণপরিষদের দাবি শুধু রাজনৈতিক কৌশল। তবে তাদের বিশ্বাস, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, রমজানের প্রথম সপ্তাহের আগে নির্বাচন হবে, এবং এতে কোনও শঙ্কা নেই। তিনি বলেন, এই পদ্ধতিগুলো শুধুই মাঠ গরম করার জন্য, প্রকৃত নির্বাচনে অংশ গ্রহণ বা না-নার বিষয়টি সবটাই রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়। আরজনে কোনও দল অংশ না নিলে সেটার কোনও ক্ষতি হবে না বলে মনে করেন তিনি। শেষমেশ, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে পুলিশ ও প্রশাসনের রদবদল নিয়েও আলোচনা হয়। সেখানে বোঝা যায়, বিএনপির সংশ্লিষ্টতা বিষয়ক প্রচারণা অমূলক। দলটি জানায়, তারা এ বিষয়ে কোনও সংশ্লিষ্টতা ندارد; তবে সরকার চাইলে বিএনপি সহযোগিতা করতে পারে, এবং সেই জন্য তারা নির্দিষ্ট একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নামও দেয়। এছাড়া, ইসলামী দলগুলো সাথে যোগাযোগ ও তাদের সঙ্গে জোটের পরিকল্পনার বিষয়েও আলোচনা হয়। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে কিছু ইসলামী দল সঙ্গে জোট হতে পারে, তবে জামায়াতের বিরুদ্ধে কোনও চুক্তি হয়নি। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির বিভিন্ন উচ্চপদস্থ নেতা যেমন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। ভার্চুয়ালি অংশ নেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস ও নজরুল ইসলাম খান।