মেক্সিকো সরকার একটি ব্যাপক প্রকল্পের পরিকল্পনা চালু করেছে, যার মূল উদ্দেশ্য হল প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরকে রেল ও বন্দরের সংযোগের মাধ্যমে যুক্ত করা। এই উদ্যোগের মাধ্যমে, এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের জন্য পণ্য পরিবহন সময় কমানো সম্ভব হবে এবং পানামা খালের বিকল্প হিসেবে নতুন এক গুরুত্বপূর্ণ রুট তৈরি হতে যাচ্ছে।
নিঅকি এশিয়ার এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানানো হয়, প্রশান্ত মহাসাগর ও মেক্সিকো উপসাগরকে সংযুক্ত করার জন্য এক ব্যতিক্রমী রেল করিডোরের আলোচনা চলছে। রেল অপারেটরদের দাবি, মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত এই সংক্ষিপ্ত রুট ব্যবহার করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য পৌঁছাতে পানামা খাল বা কানাডার রুটের চেয়ে কম সময় লাগবে।
বর্তমানে, প্যানামা খাল বিশ্ববাজারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক রুট হলেও, খরচ, জলসংকট এবং ট্রাফিক জটের কারণে অনেক সময়শিপিং কোম্পানি সমস্যার সম্মুখীন হয়। যদি মেক্সিকোর নতুন এই রুট কার্যকর হয়, তাহলে সময় ও খরচের অপূর্ব সাশ্রয় হবে এবং পানামার উপর নির্ভরশীলতা অনেকটাই কমে যাবে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কিছু মাস আগে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি অটোমেকার এই রুট ব্যবহার করে প্রথমবারের মতো পণ্য পাঠিয়েছে। এরপর, একটি বড় মার্কিন অটোমেকারও এই রুটে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর পরিস্থিতি দেখে, মেক্সিকো সরকার ব্যাহত হচ্ছে এই করিডর ও বন্দরের উন্নয়নে, যেখানে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১০,০০০ কোটি পেসো বা ৫৪০ কোটি ডলার।
পূর্বে, ইসথমাস অব তেহুয়ানতেপেকের অবস্থান প্রশান্ত মহাসাগর ও মেক্সিকো উপসাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী একটি সরু ভূমি, যা এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রেল সম্পর্ক স্থাপন করে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এখানে প্রথমবারের মতো যাত্রীবাহী ট্রেন পরিষেবা চালু হয়। এর ৩০৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইনটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় সালিনা ক্রুজ থেকে কোয়াটজাকোয়ালকোস পর্যন্ত চলে, যেখানে একটি যাত্রা সময় লাগে মাত্র সাত ঘণ্টা।
আরও দুটি লাইন এসেছে, যার প্রথমটি ৩২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ও সালিনা ক্রুজকে পলেঙ্ক শহরের সঙ্গে যুক্ত করে এবং অন্যটি ৪৫৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের, যা ভবিষ্যতে গুয়াতেমালার সীমান্তের কাছে সিউদাদ হিগাল্ডো পর্যন্ত পৌঁছাবে। এগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো এগুলোর মাধ্যমে ব্যাপক পরিমাণ কনটেইনার ও পণ্য পরিবহণের জন্য একটি সমন্বিত ফ্রেইট রেল করিডোর গড়ে তোলা।
প্রকল্পের বাস্তবায়নে নিয়োজিত সংস্থা, ইন্টারওশেনিক ট্রেন অব দ্য ইসথমাস অব তেহুয়ানতেপেক (সিআইআইটি), সম্প্রতি ৯০০টি গাড়ি গন্তব্যে পাঠিয়েছে। কোরীয় কোম্পানি জানিয়েছে, এই রুটে তাদের সময়, খরচ ও পরিচালনায় সন্তুষ্ট।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদিও এই রুট এককভাবে পানামা খালের সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতা করতে পারবে না, তবে সময় ও খরচ কমানোর দিক থেকে এটি মার্কিন বাজারে পণ্য পৌঁছানোর উল্লেখযোগ্য বিকল্প হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সাংহাই থেকে আটলান্টা পর্যন্ত রেলপথে গড়ে ২৬.৫ দিন লাগে, যা পানামুর ৩৩ দিনের তুলনায় কম। এছাড়া, পশ্চিম উপকূলের রুটে সময় লাগে ২৭ দিন এবং কানাডার পথে ২৯ দিন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে স্থল পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে, মেক্সিকো পথের ব্যবহার আরও সুবিধাজনক হয়ে উঠছে। বিশেষত, ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতির কারণে দেশটির শ্রম বৈচিত্র্য ও শ্রমশক্তির সমস্যা বেড়েছে। তবে পানামা খালের পানি সংকট রেল রুটের জন্য আদর্শ কারণ চলতি সময়ে প্রয়োজনীয় পানির অভাবে অনেক জাহাজের চলাচল ব্যাহত হয়। ২০২৩-২৪ সালে এই পানি স্বল্পতার কারণে অনেক জাহাজকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৪০ দিন পর্যন্ত।
অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য, দক্ষিণ মেক্সিকোয় পানামা খালের বিকল্প রেল করিডর লগ্নিতে উৎসাহ বাড়ছে। ইতোমধ্যে, এই রুট বরাবর বেশ কিছু শিল্প পার্ক ও গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলমান।
ইতিহাসে দেখা যায়, ইসথমাস রেললাইন প্রথম চালু হয়েছিল শতকের শুরুতে, কিন্তু ১৯১৪ সালে পানামা খাল চালুর পর তার ব্যবহারে কমতি আসে। ১৯৯০-এর দশকের মধ্যে মেক্সিকোয় প্রায় পুরোপুরি রেলসেবা বন্ধ হয়ে যায়। তবে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ক্লদিয়া শেইনবামের প্রশাসন এই রেল যোগাযোগের পুনরুজ্জীবনের পরিকল্পনা নিয়েছে, যার লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের রেল নেটওয়ার্ককে তিন হাজার কিলোমিটার পরিমাণে বৃদ্ধি করা।
তবে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, বড় জাহাজ চলাচলের সক্ষমতা, এবং বিশ্বব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহারের পর্যাপ্ততা এখনও মেক্সিকোর নতুন রুটের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হারিয়ে নিতে পারেনি। এছাড়া, অবকাঠামো উন্নয়ন সম্পূর্ণ হওয়ার আগে মাল পরিবহণের গতি ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা কঠিন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিশ্ববাণিজ্যে নতুন রুটের প্রয়োজন এখনই। বিশেষ করে, এশিয়া–আমেরিকা বাণিজ্য যখন দ্রুত বাড়ছে, তখন বিকল্প রুটের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি এই মেক্সিকো প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে তা বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যে বড় পরিবর্তন আনতে পারে এবং দেশটির জন্য বড় অর্থনৈতিক সুবিধা সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে।