বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক দিক থেকে দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে রফতানি ও প্রবাসী আয়ের ধারা শক্তিশালী হয়ে উঠছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইতিবাচক অবস্থানে আছে। তবে অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির প্রাণবলিদান বলে পরিচিত বেসরকারি খাত গুরুতর সংকটের মুখোমুখি। বিনিয়োগের হার কমে গেছে, শিল্পকারখানার উৎপাদন স্থবির হয়ে পড়েছে এবং এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।
শিল্পে অচলাবস্থা
শিল্প কারখানার উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য আশেপাশের সময়ের তুলনায় অনেক বেশি প্রতিকূল। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ না থাকায়, ব্যাংকের সুদ হার ১৬ শতাংশে পৌঁছেছে। সঙ্গে আছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলা কঠিন হয়ে পড়া এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও শ্রম আইন সংস্কার নিয়ে ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তা। এতে নতুন বিনিয়োগ দেখতে অনেকের মধ্যে মনোবল হারিয়ে গেছে, বরং পুরোনো বিনিয়োগও ঝুঁকির মুখে। কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, হাজার হাজার শ্রমিক চাকরি হারাচ্ছেন।
ব্যবসায়ী সংগঠনের উদ্বেগ
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “আমাদের বড় সমস্যা এখন ব্যাংক খাত। ঋণ পাওয়া কষ্টসাধ্য, আমদানি-রফতানি আটকে আছে। এছাড়া কাস্টমসের হয়রানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যার সমাধান না হলে ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাবেন না।”
বিজিএমইএ সভাপতি মো. শাহরিয়ার আরও জানান, বর্তমানে মূলধনী খাতে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি খুবই কমে গেছে। মূলত একমাত্র ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা হচ্ছে, কিন্তু নতুন কারখানা বা শিল্প সম্প্রসারণ এখন বেশ বাধাগ্রস্ত। বিনিয়োগের কমতির অন্যতম কারণ হচ্ছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির হার হ্রাস, যা ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধির কমতির প্রতিফলন।
ঋণ প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে নিম্ন পর্যায়ে
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চলতি বছর জুনে প্রাইভেট সেক্টরের ঋণ প্রবৃদ্ধি ৬.৪৯ শতাংশে নেমে এসেছে, যা অতীতের সব রেকর্ডের মধ্যে সবচেয়ে কম। অন্যদিকে, সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৩ শতাংশের উপরে থাকলেও, বেসরকারি খাতে অনেক বেশি সংকোচন দেখা যাচ্ছে। সরকার বেশি কর আদায়ের জন্য ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছে, ফলে বেসরকারি খাতের জন্য ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা নতুন শিল্প ও কর্মসংস্থানের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে সতর্কবার্তা
অন্টারনেট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর প্রকাশিত ২০২৫ সালের বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য পাঁচটি বড় বাধা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, সীমিত অর্থায়ন, জটিল আমলাতন্ত্র, বৈষম্যকর কর কাঠামো ও দুর্নীতি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম অনুসরণ করেও বিনিয়োগের পরিবেশ তেমন পরিবর্তন আসেনি।
অপরদিকে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) তাদের এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-এ বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কিছুটা কমিয়ে ৫ শতাংশ করেছে। তারা সতর্ক করে বলেছে, নতুন মার্কিন শুল্ক, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ও ব্যাংক খাতের দুর্বলতা দেশটির রফতানি ও বিনিয়োগে ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
ছোটো স্বস্তি ও ভবিষ্যতের শঙ্কা
অর্থনীতির দিশেহারা পরিস্থিতির মধ্যেও সাধারণ মানুষের জন্য কিছু স্বস্তি এসেছে, মূলত মুদ্রাস্ফীতির হ্রাসে। আগস্টে দেশের মুদ্রাস্ফীতি ৯.৭ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত দু’বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। তবে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি বাড়ছে এবং সরকারি অর্থায়নের অগ্রগতি খুবই কম। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে উন্নয়ন কার্যক্রম প্রায় অর্ধেকেরও কমে পৌঁছেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন জরুরি তিনটি পদক্ষেপ—রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, ব্যাংক খাতের বিশ্বাস পুনঃস্থাপন ও জ্বালানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া। অন্যথায়, বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান সংকট গভীর হয়ে উঠবে, যা সমাজে অস্থিরতা আর রাজনৈতিক অস্থিরতার ঝুঁকি বাড়াবে।