বাংলাদেশে ডিজিটাল যুগের বিকাশে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে দেশের মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটির বেশি, যার মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারকারী মোট ৬৯ মিলিয়নের বেশি। এছাড়াও, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম রিলসসহ অন্যান্য সামাজিক প্ল্যাটফর্মে কোটি কোটি মানুষ সক্রিয় থাকছেন। এই পরিবর্তন যোগাযোগ ও ব্যবসার ক্ষেত্রে সহজতা এনে দিলেও, এর নেতিবাচক ফলাফলও দেখা যাচ্ছে। সামাজিক ভারসাম্য, মানসিক স্বাস্থ্য, উৎপাদনশীলতা ও অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই ডিজিটাল অগ্রগতি কতটা প্রয়োজনীয় ও কতটা প্রভাব বিস্তার করছে দেশের সার্বিক উন্নয়নে।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে প্রায় ১০ কোটি সক্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী প্রতিদিন গড়ে ২.৫ থেকে ৩ ঘণ্টা সময় এই প্ল্যাটফর্মে ব্যয় করেন। যদি ধরে নেওয়া হয় প্রতি ঘণ্টার অর্থনৈতিক মূল্য ০.১২ ডলার, তাহলে দেশের বার্ষিক উৎপাদনশীলতা প্রায় ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এই ক্ষতির ফলে সরাসরি দেশের অর্থনীতি ও শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
অবশ্য, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিপদও দেখা দিয়েছে। চলতি বছর এপ্রিলের একটি দৃষ্টান্তে আখাউড়ায় ট্রেনের ছাদে ভিডিও চিত্র ধারণ করতে গিয়ে দুজন তরুণের মৃত্যু হয়। গাজীপুরের শাপলা বিলের নৌকা ডুবিতে দুই কিশোরের মৃত্যু, সুনামগঞ্জে ভিডিও ধারণ করতে গিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজন নিহত এবং মানসিক অবস্থা খারাপ হওয়া, লালমনিরহাটে স্টান্ট ভিডিও করতে গিয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কিশোরের মৃত্যু এবং রাজবাড়ীতে ট্রেনে কাটা পড়ে শিক্ষার্থীর মৃত্যু—এসব ঘটনা প্রমাণ করে সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহারে কতটা বিপদ বাড়ছে।
তথ্য ও প্রযুক্তির এই যুগে, তরুণ তরুণীদের মধ্যে উদ্বেগ, হতাশা, মানসিক অবদমন ও আত্মসম্মানহীনতা বাড়ছে। অনলাইন তুলনা ও ‘ভিউ’, ‘লাইক’ এর চাপ বিবাহবিচ্ছেদ, দাম্পত্য কলহের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সাইবার বুলিং, অনলাইন হয়রানি ও পর্নোগ্রাফি তরুণ প্রজন্মের মানসিক স্থিতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
বিশ্বের বিভিন্ন বড় টেক কোম্পানির সম্ভাব্য ক্ষতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, যদি বাংলাদেশ সোশ্যাল মিডিয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়, তবে তার প্রভাব খুবই মারাত্মক। মেটার বাজারমূল্য ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশে ৬৯ মিলিয়ন ব্যবহারকারী থাকায় সম্ভাব্য ক্ষতি প্রায় ৪১.৪ বিলিয়ন ডলার। গুগলের ইউটিউবের ক্ষেত্রেও একই রকম, সম্ভাব্য ক্ষতি প্রায় ৩৭.৫ বিলিয়ন ডলার। আর টিকটকের জন্য এই ক্ষতি মোট ১২ বিলিয়ন ডলার। মোট মিলিয়ে, বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করলে মোট সম্ভাব্য বাজার ক্ষতি প্রায় ৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পাশাপাশি, বাংলাদেশে এখনও কোনও ডিজিটাল সার্ভিস ট্যাক্স চলু নেই, যা অনেক দেশের তুলনায় বেশ পিছিয়ে। ভারত, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া এবং স্পেন ইতোমধ্যে এই খাতে ব্যাপক রাজস্ব আয় করছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের রাজস্ব প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে, বিভিন্ন দেশের মতো চীন, রাশিয়া ও ভারত সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য কড়া নীতি গ্রহণ করেছে। চীন সেখানে বিদেশি প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দিয়েছে; রাশিয়া কিছু প্ল্যাটফর্মে সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। আর ভারতে কঠোর ডেটা নিয়ন্ত্রণ ও কনটেন্ট ফিল্টারিং আইন প্রয়োগ চলছে। আমাদের দেশে সেই ধরনের কার্যকর আইনের অভাব রয়েছে।
নেতৃস্থানীয় সংস্থাগুলোর দাবি, এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য কিছু নীতি গ্রহণের প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে- ডিজিটাল সার্ভিস ট্যাক্স চালু, ঝুঁকিপূর্ণ কনটেন্টের বিরুদ্ধে কঠোর আইন, সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি নিয়ন্ত্রণে সচেতনতামূলক কর্মসূচি, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কেন্দ্র সম্প্রসারণ, সাইবার অপরাধ ও হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থাপনা, এবং দায়িত্বশীল অনলাইন ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ।
সমাপনী বার্তায় বলতে হবে, সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনকে সহজ করে দিয়েছে, কিন্তু এর অপব্যবহার আমাদের মূল্যবান সময়, অর্থ ও জীবন কেড়ে নিচ্ছে। এখনই সময় স্পষ্ট নীতি, জাগরूकতা এবং কার্যকর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রযুক্তির সুফল গ্রহণ করে তা উন্নয়নের শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, যাতে এই ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রতিরোধের না হয়ে, বরং সমৃদ্ধির পাথেয় হয়ে উঠে।