কুড়িগ্রামের তিস্তা নদীর চরাঞ্চলগুলোতে জীবনযাত্রা ও স্বাস্থ্য পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। চর খিতাবখাঁ গ্রামের ইউসুফ আলী (২৮) বলে থাকেন, দুর্যোগকালীন সময়ে তারা হাগা ও নাপা ট্যাবলেট ব্যবহার ছাড়া আর কোনও চিকিৎসা পায় না। গরম বা ঠাণ্ডার কারণে বডি অসুস্থ হলে সাধারণত তারা নাপা বা হলুদ ট্যাবলেট খেয়ে থাকেন। চরে কোনও ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র না থাকায় গুরুতর অসুস্থ হলে অন্যত্র যেতে হয়, যেখানে গিয়ে অনেক সময় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা আর সম্ভব হয় না। তিনি বলছেন, গর্ভবর্তী নারীদের জন্য প্রসবের সময় নদী পার হয়ে ধাইয়ানী (প্রাথমিক চিকিৎসক) নিয়ে যেতে হয়, যা প্রায়শই রাতের অন্ধকারে কঠিন হয়ে পড়ে। ধাইয়ানীদের জন্য ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়, যা অনেকের কাছে যোগ্যতা হয় না, ফলে অনেক সময় রোগীর জীবন ঝুঁকিতে পড়ে।
আনুমানিক ২৫টির মতো চরে জীবনযাত্রা চলাচলের উপযোগী দ্বীপপ্রান্তে বাস করে এই চরবাসীরা। এই এলাকাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: শাওলার চর, অতিদেবের চর, ঠুঁটাপাইকরের চর, বিদ্যানন্দের চর, গাবুর হেলানের চর, হায়বত খাঁর চর, বিশ-বাইশের চর, আজমখাঁর চর, শিয়াখাওয়ার চর, হরিচরনের চর, গনাইর চর, চর হংসধর, চর পাড়ামৌলা, চর চতুরা, চর মনস্বর, চর তৈয়বখাঁ, চর খিতাব খাঁ, চর মেদনী, চর গতিয়াসাম, মাঝের চর, চর বগুড়া পাড়া, ঝুমারার চর, চর নাখেন্দা ও শনশানার চর—সব মিলিয়ে এই এলাকাগুলোর জীবনমান ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রধান সমস্যা হচ্ছে সুপেয় পানির প্রতিবন্ধকতা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা ও সচেতনতার অভাব। বিশুদ্ধ পানি না থাকায় রোগে ভুগছে চরের মানুষ। তারপরও কোনও সরকারি বা বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, ডাক্তার বা নার্স থাকেন না। এরা অধিকাংশই নদী পথে নৌকা করে চলাফেরা করে, কিন্তু অনেক সময় যোগাযোগ বা বৈরি পরিস্থিতির কারণে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানো যায় না। নারী ও বৃদ্ধারা এই পরিস্থিতিতে শারীরিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে পড়েছেন। বারবার বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে সন্তান প্রসব, অসুস্থতা বা জরুরি চিকিৎসার জন্য নৌকা বা অপ্রতিষ্ঠিত যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভর করতে হয়।
স্বাস্থ্য পরিস্থিতির বিষয়ে চরবাসীদের বক্তব্য, ধরুন নেতা বা প্রতিষ্ঠান এলেও প্রাথমিক পর্যায়ে দ্রুত চিকিৎসার জন্য কোনও উপায় অন্তত নেই। চরিয়াল নৌকা থাকলেও ডেকে আনতে বা চালাতে সমস্যা হয়। মূলত, অনেকের নৌকা চালানোর লোক বা টেকনিক্যাল দক্ষতা খুবই কম। চর খিতাবখাঁ গ্রামের জয়নুদ্দী, সলিম, সোলেমান, মোতালেবসহ অনেকে বলেন, আগে সরকারি বা এনজিও কার্যক্রম খুবই অপ্রতিষ্ঠিত ছিল। তবে সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগে পরিস্থিতি কিছুটা改善 হলেও, এখনো জরুরী চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা ও মানসম্পন্ন চিকিৎসক বা নার্সের অভাবের কারণে ঝুঁকি অব্যাহত।
রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আল ইমরান বলছেন, চরাঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন নাগরিক ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে পিছিয়ে। তারা এখনো নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকছেন। তবে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন নানা ধরণের সহায়তা চালাচ্ছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ‘রাইট হাউজ’ নামে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দূর্যোগ ও জরুরি তথ্য আরও দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব হবে।
প্রকল্পের সহায়তায়, ‘এম্পাওয়ারিং কমিউনিটিজ ফর ইন클ুসিভ ডিজাস্টার রেসিলিয়েন্স’ নামে এক উদ্যোগের আওতায় কুড়িগ্রাম জেলা, বিশেষ করে সদর, রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী ও রাজিবপুরের চরাঞ্চলে দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য নানা প্রশিক্ষণ, সেবা ও উন্নয়ন কাজ চলমান। কিন্ত মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা, প্রাথমিক হাসপাতাল, নৌ অ্যাম্বুলেন্স ও দ্রুত যোগাযোগের জন্য অবকাঠামোগত পরিকল্পনা আরও জোরদার করার দাবি রয়েছে।
অবশ্য, স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও সচেতন মহলের দাবী, তিস্তার চরাঞ্চলে কমিউনিটি ক্লিনিক ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে পর্যাপ্ত ওষুধ, মানসম্পন্ন ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মী নিয়োগের জন্য। বিশেষ করে জরুরি পরিস্থিতির জন্য নৌ অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এর পাশাপাশি নদীপথের উন্নয়ন, স্বাস্থ্যবিধি ও পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করতে হবে। সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাও এই অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় অবশ্যই জরুরি।
সংক্ষেপে, চরবাসীদের স্বাস্থ্য ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য অবকাঠামো, সেবা ও সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করছে সবাই। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয় সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এই পরিস্থিতির পরিবর্তনে অনেক সাহায্য করবে বলে প্রত্যাশা।

















